মৃত্যুর কাছে হাঁটু গেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলে ৬০ দশকে জন্ম নেওয়া উত্তরাঞ্চলের লিটলম্যাগ নামে খ্যাত আন্দোলনের পুরোধা কবি সরোজ দেব (৭৬)।গত সোমবার বেলা ২টার দিকে গাইবান্ধা শহরের পূর্বপাড়ার নিজ বাড়িতে অসুস্থ জনিত অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন তিনি।
সরোজ দেব ১৯৪৮ সালের ২৬ মার্চ গাইবান্ধা শহরের পূর্বপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা প্রখ্যাত ধ্রুপদী সঙ্গীত শিল্পী ওস্তাদ উপেন্দ্র নাথ দেব ও মাতা সান্তু দেব।
গত ২৫ ডিসেম্বর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কবিকে বেসরকারি একটি ক্লিনিকে নিয়ে যান সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বিপ্লব। পরে গুরুতর অবস্থায় তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করেন গাইবান্ধা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক প্রমতোষ সাহা ও সাখাওয়াত হোসেন বিপ্লব। পরে ২৮ ডিসেম্বর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কবির মূত্রথলি থেকে টিউমার অপসারণ করা হয়।এরপর তিনি বিভিন্ন জনের আর্থিক সহায়তায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাড়িতেও ছিলেন বেশ কিছুদিন।
কবি সরোজ দেব ছিলেন গাইবান্ধার সর্বজন প্রিয় এক ব্যক্তিত্ব। স্কুল জীবনেই সরোজ দেবের কাব্যিক প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। পরে কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি গাইবান্ধা সহ উত্তরাঞ্চলে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। শুরু করেন ‘শব্দ’ সম্পাদনা। কলেজ জীবন থেকেই ‘শব্দ’ সম্পাদক হিসেবে নাম অর্জন করেন তিনি। একটানা ৫৬ বছর ‘শব্দ’ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও স্বজন শব্দাবলী, প্রাণেশ্বরীর মাচান, বজ্রে বাজে বেণু, লাল গোলাপের জন্য, শতদল, মোহনা, সংশপ্তক, শতাব্দী, নান্দনিক ইত্যাদি বিভিন্ন নামে দেড় শতাধিক সাহিত্য পত্রিকা বা লিটলম্যাগ বিভিন্ন সময়ে সম্পাদনা করেছেন। ষাট (৬০) দশক থেকে তার পদচারণায় মুখরিত ছিল গাইবান্ধার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন। গাইবান্ধার সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সূর্যকণা’ তার হাতেই প্রথম গড়া।
তিনি সাহিত্যাঙ্গনে মেধা, মনন আর আপন আলোয় ছিলেন উদ্ভাসিত। ‘শব্দ’ তার আপন ভুবন। যিনি ভালোবাসতেন কবিতা, হৃদয়ে লালন করেন কবিতা, যিনি গভীরভাবে ভালোবাসেন তার দেশ, মা, মাটি ও মানুষকে। শব্দের দ্যোতনা ও ব্যঞ্জনায় বাক্সময় করে তোলেন কোনো বিষয় বৈভবকে। তিনি ছিলেন ছোট বড় সকলের কবি।
সরোজ দেব ১৯৬৯ সালে গাইবান্ধা কলেজ ছাত্র সংসদের ম্যাগাজিন সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার সরোজ দেব দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। বিজয়ী হয়ে ফিরে এসে তিনি ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও গড়েছেন একাধিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
সরোজ দেব স্কুল জীবন থেকে কবিতা লেখা শুরু করলেও তার কবিতার বই বেরিয়েছে অনেক পরে। তার রচিত কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে, ধবল মেঘের দিনগুলো (২০০৬), অনন্ত রোদ্দুরে এসো (২০০৯), স্বরচিত সুখের সৎকার (২০১০), স্বপ্ন শুয়েছিল কুয়াশায় (২০১১) ও সময় আমাকে হত্যার কথা বলে গ্যাছে (২০১৩)। তার লেখার তুলনায় বইয়ের সংখ্যা অনেক কম।
এছাড়াও মৃত্যুর কাছে হাঁটু গেড়ে/যে মানুষ মৃত্যু ভিক্ষা চায়/তার মতো দুঃখী কে/তার মতো হাহাকার/কে আছে কোথায়/তার দুঃখে নিদারুণ দুঃখীও খানিকটা থমকে দাঁড়ায়/তার হাহাকারে/সাগরের লোনা জল/আরও লোনা হয়ে যায়/কেননা জীবন বড় প্রিয় উচ্চারণ/কেননা জীবন বড় প্রিয় আলিঙ্গন’ (মৃত্যুর কাছে-সরোজ দেব) উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া তিনি অনেকগুলো গ্রন্থও সম্পাদনা করেছেন। সেগুলো হলো, রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসার গল্প (২০০৬), শরৎচন্দ্রের ভালোবাসার গল্প (২০০৬), কবিতার যৌথ খামার (২০০৯), নির্বাচিত কবিতা (২০১২) ও ছোটদের শরৎচন্দ্র (২০১২) পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক সাঁড়া দেয়।
জীবনে এই চলার পথে তিনি বেশ কিছু মূল্যবান সম্মাননা পেয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুখ্যমন্ত্রী আবুল হোসেন সরকার পদক (১৯৪৭), স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী পদক (২০০০), বিন্দু বিসর্গ সাহিত্য পুরস্কার (২০০৩), একুশের শহীদ স্মৃতি পদক (২০০৬), আদিবাসী সাহিত্য পদক, ময়মনসিংহ (২০০৭), দুই বাংলার কবিতা উৎসব পদক (২০০৭), ছান্দসিক পদক (২০০৮), আনোয়ার আহমেদ স্মৃতি পদক (২০০৯), অভিযাত্রিক, রংপুর পদক (২০০৯), শেরপুর লেখক চক্র পুরস্কার (২০১০), ছোট কাগজ পুরস্কার, ঢাকা (২০১১) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাত বিভাগে প্রকাশিত লিটল ম্যাগ চিহ্ন সম্মাননা, লিটলম্যাগ মেলা-২০১১-তে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার সম্পাদিত ‘শব্দ’ শ্রেষ্ঠ লিটলম্যাগ এবং তিনি শ্রেষ্ঠ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের (দার্জিলিং) বাংলা বিভাগের রজতজয়ন্তী উৎসবে কবিকে সংবর্ধিত ও সম্মাননা প্রদান করেছেন। ২০১৯ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণ উন্নয়ন কেন্দ্র কর্তৃক সাহিত্যে জিইউকে অ্যাওয়ার্ড পদক অর্জন করেন তিনি। সর্বশেষ ২০২১ সালে সমধারা সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ করেন।
গভীর শিল্পবোধ, সজীব সজাগ দৃষ্টি, স্থির নির্ভুল বিষয় চেতনা এবং প্রকৃতির নানা বৈচিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ সমস্তই কবি সরোজ দেবের মনোজগৎকে আলোকিত করেছে। কবির ভেতরে ছিলো যেমন শিল্পবোধ তেমনি ছিলো দায়বোধ।
তিনি অত্যন্ত সাধারনভাবে জীবন যাপন করতেন। শেষ জীবনে তিনি প্রায় একাকি হয়ে পড়েন। এক ছেলে আছে সে-ও বেকার থাকায় বিবাহিত ছেলের পরিবারও কবির আয়ে চলত। আয় বলতে কবির তেমন কিছু ছিল না। অনেক অন্যের কাছে সাহায্য চেয়ে চলে কবির চলতো কবির সংসার। তবে তিনি কখনও প্রয়োজনের বেশি কারো কাছে নিতেন এবং সবার কাছেও তিনি সহায়তা গ্রহণ করতেন না।
গাইবান্ধা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বিপ্লব কবি সরোজ দেব এর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন গাইবান্ধাসহ দেশ এক মহান ব্যক্তিকে হারালাম।
সাংবাদিক রিক্ত প্রসাদ জানান সরোজ দেব যুগ যুগ ধরে মানুষের অন্তরে থাকবে। গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রধান ও উন্নয়ন গবেষক এম. আবদুস সালাম বলেন প্রিয় এক মানুষের বিদায় হলো। তবে, কবি সরোজ দেব এর অবদান সমাজ অনন্তকাল স্মরণ রাখবে।
কবিতা ও শব্দ যার আপন ভুবন, হালকা-পাতলা ফর্সা মুখভর্তি লম্বা দাড়ি গড়নে ঠিক যেন রবিরয় এর মতন। পড়নে পাজামা পাঞ্জাবি কাঁধেতে ঝুলানো ব্যাগ আমাদেরই কবি সরোজ দেবকে আর দেখা যাবে না। তিনি ওপারে চির শান্তিতে থাকবেন এই কামনা যেন থাকে সেই প্রত্যাশা সৃষ্টিকর্তার কাছে গাইবান্ধা সহ কোটি মানুষের পক্ষ থেকে রইল প্রানউজ্জল কবি সরোজ দেব নাথ এর জন্য চিরাত্নন গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।