স্ত্রী ও উত্তরপুরুষ
সীতারামের উত্তরপূরুষ সম্পর্কে কোন উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। তার ৩টি, মতান্তরে ৫ জন স্ত্রী ছিল বলে জানা যায়। তার প্রথমা স্ত্রীর নাম কমলা। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। তার অন্য একজন স্ত্রীর নাম ‘শ্রী’।
এ ‘শ্রী’ থেকেই ‘শ্রীপুর’ (উপজেলা) নামকরণ হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। মহম্মদপুর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দুরে বালিদিয়া ইউনিয়নভূক্ত ‘শ্রীপুর’ নামে একটি গ্রামও রয়েছে। মাগুরা জেলায় আরও একাধিক ‘শ্রীপুর’ নামের গ্রামের অস্তিত্ব বিদ্যমান। অনেকের মতে, সীতারামের স্ত্রী ‘শ্রী’-র নামানুসারেই এই গ্রামগুলির নামকরণ করা হয়েছে। শোনা যায় সীতারামের ভ্রাতা লক্ষীনারায়ণ ও তার উত্তর পুরুষগণ হরিহরনগরে দীর্ঘকাল যাবৎ বসবাস করেন। যাহোক সীতারামের পতনের পর তার রাজ্য নাটোরের জমিদার রামজীবন রায় ও চাঁচড়ার জমিদার মনোহর রায় এবং নলডাঙ্গার জমিদারের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দেওয়া হয়।
মুঘলদের সাথে বিরোধ
যদুনাথ সরকার রাজা সীতারাম রায়কে রাজা প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে তুলনা করেন। রাজা সীতারামের জমিদারী পাবনা জেলার দক্ষিণভাগ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এবং নদীয়া জেলার পূর্বপ্রান্ত থেকে বরিশাল জেলার মধ্যভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তার বাৎসরিক রাজস্ব আয় ছিল ৭৮লক্ষ টাকা। বিস্তৃীর্ণ এলাকার জমিদার রাজা সীতারাম স্বল্প কালের মধ্যে প্রবল প্রতাপশালী হয়ে উঠেন এবং বাংলার শাসকদের স্বাধীনতা প্রিয়তার বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে জাগ্রত হয়ে উঠে। তিনি বাংলার সুবাদারকে দেয় রাজস্ব বন্ধ করে দেন। সুবাদার ইব্রাহিম খানের দুর্বল শাসন ব্যবস্থা, মুর্শিদকুলী খান এবং আজিমুশ্শানের মধ্যকার বিরোধ তার স্বাধীনতা লাভের ইচ্ছাকে আরও উজ্জ্বীবিত করে। সীতারামের সমৃদ্ধি এবং প্রাধান্য অন্যান্য জমিদারদের মনে হিংসার উদ্রেগ করে। জমিদারগণ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং সীতারামের বিরূদ্ধে মোগল ফৌজদারের কান ভারী করতে থাকে।
আজিমুশশান বাংলার সুবাদার নিয়োজিত হবার পর মীর আবু তরাপ নামে তার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে ভুষান এর ফৌজদার নিয়োগ করেন। যদিও আবু তরাপের মূল দায়িত্ব ছিল সীতারামকে নিরীক্ষণ করা কিন্তু তিনি তা না করে সেখানে এক ত্রাসের রাজত্বের সৃষ্টি করেন। আবু তরাপ কর দিতে ব্যর্থ প্রজাদের জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতেন। সীতারাম বিষয়টি জানার পর মুঘল রাজকোষে আর একটি টাকাও কর দেয়া থেকে বিরত থাকেন। আবু তরাপ সীতারাম রায় কে তার এই সিদ্ধান্তের পরিণতি সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেন।
তৎকালীন বাংলার দেওয়ান মুর্শিদকুলি খানের সাথে আবু তরাপের সুসম্পর্ক ছিল না। ঘটনা ক্রমে সীতারাম তা জানতেন। আজিমুশান সে সময় দিল্লি অবস্থান করছিলেন। তার পুত্র ফররুখসিয়ার তখন ভারপ্রাপ্ত সুবাদার। তিনি বাংলার চেয়ে দিল্লির উন্নয়নে বেশি আগ্রহী ছিলেন। বাংলার রাজধানী তখন ঢাকা থেকে পাটনায় স্থানন্তরিত করা হয়েছে। এই অবস্থায় আবু তরাপের পক্ষে সুবাদার অথবা দেওয়ান এর নিকট থেকে কোন সাহায্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। তাই তিনি নিজেই রাজা সীতারাম এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সচেষ্ট হন। আবু তোরাপ ছিলেন একজন ফৌজদার। তার নিয়ন্ত্রণে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য থাকায় তিনি সীতারামের সাথে পেরে উঠলেন না। ১৭১৩ সালে মুর্শিদকুলি খান বাংলার সুবাদার নিয়োজিত হন। আবু তরাপ তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। সুবাদার তাকে কোন সাহায্য করেননি। আবু তরাপ আরো একবার সীতারাম এর বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন কিন্তু মুঘল বাহিনী এবারও সীতারামের গেরিলা বাহিনীর বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারেনি। এরপর আবু তরাপ তার সিপাহসালার পীর খানকে প্রেরণ করেন।
মুঘল গোলন্দাজ বাহিনী মধুমতির তীরে অবস্থান নেয়। বারাশিয়া নদীর তীরে মুঘল বাহিনী এবং সীতারামের বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়। মির আবু তরাপ সেনাপতি মিনা হাতির নিকট নিহত হন বারাসিয়া নদীর তীরে এক খন্ড যুদ্ধে ১৬৯৯খ্রীঃ এ। ‘তোরাপের মাজার’ বলে কথিত ভূষণা সেনানিবাসের মাঝে আজও তার কবর নীরব সাক্ষী হয়ে আছে। ‘তোরাপের মাজার’ বলে কথিত ভূষণা সেনানিবাসের মাঝে আজও তার কবর নীরব সাক্ষী হয়ে আছে।
সীতারামের বাহিনী আরো অগ্রসর হয় এবং ভূষণের কেল্লা দখল করে নেয়। সীতারাম তার বাহিনীর একটি অংশকে কেল্লায় অবস্থান করতে বলেন এবং সমগ্র এলাকার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। সীতারামের সেনারা মধুমতি নদীর তীরে অবস্থান নেয়। সীতারাম জানতেন যে মুঘল বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ এড়ানো যাবে না। তাই তিনি তার পদাতিক ও গোলন্দাজ বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন।
আবু তরাপের নিহত হবার খবর মুর্শিদাবাদে মুর্শিদকুলি খানের নিকট পৌছালে তিনি তার শ্যালক বক্স আলী খানকে ভূষণের নতুন ফৌজদার হিসেবে নিয়োগ করেন। তিনি সকল জমিদারদের সীতারাম এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুঘল বাহিনীকে সাহায্য করবার জন্য আদেশ দেন। নতুন ফৌজদার বক্স আলি খান এর সাথে ছিলেন সুবাহ বাংলার সেনাপ্রধান সংগ্রাম সিংহ।মোগল প্রভুভক্ত নিকটবর্তী জমিদার এবং দিঘাপতিয়ার জমিদার দয়ারামকে অনুরূপ নির্দেশ প্রদান করা হয়। সংগ্রাম শাহ্, সিংহরাম ও দয়ারাম প্রমুখের সহযোগিতায় ফৌজদার বক্সআলী খান সীতারামের ভূষণা দুর্গ আক্রমণ করেন। মধুমতী তীরে প্রচন্ড লড়াই শুরু হলো। যুদ্ধে প্রথমদিকে সীতারামের জয় হলেও শেষ পর্যন্তু তিনি সম্মুখসমরে টিকে থাকতে পারলেন না। অতপর রাতের অন্ধকারে তিনি তার সৈন্যদের নিয়ে ভূষণা থেকে রাজধানী মহম্মদপুরের দিকে অগ্রসর হন। মোগল সৈন্যরাও তার পশ্চাদ অনুসরণ করে।
মহম্মদপুরের দুর্ভেদ্য দুর্গে অবস্থান করে রাজা সীতারাম রায় স্বীয় স্বাধীনতা রক্ষায় ব্রতী হন। প্রধান সেনাপতি মেনাহাতী বীরবিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মোগল পক্ষের যুদ্ধ জয় অসম্ভব হয়ে পড়ে। কুটিলতার আশ্রয় নেন মোগল বাহিনীর সমর্থক স্বার্থান্বেষী মহল।
এ যেন পলাশীর যুদ্ধের ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতার পূর্ব মহড়া। বিশ্বাসঘাতক কর্মচারী মুনিরামের পরামর্শে, কুচক্রী জমিদার দয়ারামের সহযোগিতায় প্রধান সেনাপতি মেনাহাতীকে অতর্কিতভাবে দোলমঞ্চের নিকট আক্রমণ করে আহত অবস্থায় বন্দী করা হয়। ৭ দিন পর্যন্ত তাদের হাতে নিদারুন নির্যাতনের পর তার মৃত্যু হয়। শত্রু সৈন্যরা তার মস্তক ছেদন করে নবাব মুর্শিদকুলী খানের নিকট মুর্শিদাবাদে প্রেরণ করেন। বিশালকার এই মস্তক দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে এতবড় বীরকে হত্যার জন্য নিজের সৈন্যদেরকে তিরস্কার করেন।
মুর্শিদাবাদ থেকে মস্তকটি ফেরত এলে যথারীতি সৎকার করে সমাহিত করা হয়। বাজারের উত্তর-পূর্ব কোণে ইট নির্মিত মেনাহাতীর সমাধিসৌধের চিহ্ন এখন আর নেই। বর্তমান মোঃ আলিমুজ্জামান সাহেবের বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রাস্তার নিচে এখন এটি চাপা পড়ে গেছে।